Source
बांग्ला आर्सेनिक : प्रोक्ति ओ प्रतिकार
পশ্চিমবঙ্গে 19টি জেলার মধ্যে 9 টি জেলাই আজ আর্সেনিক পীড়িত। আর্সেনিক আক্রান্ত জনসংখ্যা 4.27 কোটি। চাপা কলের সংখ্যা 30 থেকে 40 লক্ষ। সর্বাপেক্ষা আর্সেনিক-পীড়িত জেলাগুলি হল- মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগণা।
1984 সালে বাংলাদেশের খুলনা জেলা ও চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে কিছু আর্সেনিক রোগী এসেছিলেন। কিন্তু 1995-এর ফেব্রুয়ারি মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্সেনিকের প্রথম বিশ্বসম্মেলনের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, কর্তৃপক্ষ ও সরকারি মহল বাংলাদেশে আর্সেনিকের কোনও খবরই রাখতেন না।1984 সালে নলকূপের জলে আর্সেনিক নিয়ে আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান সহ কলকাতার বিভিন্ন কাগজে হৈ চৈ হলে আর্সেনিকের খবর কাগজে প্রকাশ হওয়ায় ডঃ সাহা কর্তৃপক্ষের কাছে ধমক খান। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, সরকারি কর্মচারী হিসাবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তিনি এইসব খবর বাইরে প্রকাশ করতে পারেন না। এর পরে জনসাধারণের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলাও দায়ের করা হয়।
এরপর ডঃ সাহা পাবলিক হেলথের (ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠান) অধ্যাপক চক্রবর্তীর সঙ্গে মিলিতভাবে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় আর্সেনিক রোগ অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন। যে অঞ্চল থেকে একাধিক আর্সেনিক রোগী তিনি পেতেন সেখানেই তাঁরা অনুসন্ধানে যেতেন। তাঁরা ক্ষেত্র সমীক্ষা করলেন বারাসতের গঙ্গাপুরে, বারুইপুরের রামনগরে, নদীয়ার চর-কাতলামারি ও মুর্শিদাবাদের অন্যান্য স্থানে এবং বর্ধমানের চম্পাহাটি ও রাসুতপুরে। 1987 সালে ডঃ সাহা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
ডঃ দীপঙ্কর চক্রবর্তী 1987 সাল থেকে বাংলায় আর্সেনিক গবেষণা শুরু করেন। তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও চিনে গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন। ডঃ সাহার সঙ্গে তাঁর প্রকৃত পরিচয় 1995 সালে। সেই থেকে তাঁদের যৌথ গবেষণা, ক্ষেত্র সমীক্ষা অব্যাহত। ডঃ চক্রবর্তী নলকূপের আর্সেনিক বর্ধিত মাত্রাঞ্চল থেকে রোগীর অনুসন্ধান করেন। আর ডঃ সাহা হাসপাতালের রোগী থেকে নলকূপে যান। ডঃ সাহার কাছে তাঁর আবিষ্কারের ইতিহাস শুনতে শুনতে এপিডেমিওলজি শাস্ত্রের পথপ্রদর্শক ইতিহাসখ্যাত লণ্ডন কলেরার কারণ আবিষ্কারক ডঃ জন স্নো-র কথা মনে পড়েছিল। 1854 সালে লণ্ডন কলেরার কারণ যে পয়ঃপ্রণালী দূষিত কলের জলের জন্য তা আবিষ্কার করেন। ডঃ স্নো. কলের জলে আর্সেনিক যে মারাত্মক জানপদিক অসুখের কারণ হতে পারে তা কলকাতার চিকিত্সক মহলে তখন অজ্ঞাত প্রায়ই ছিল।
1976 -এ বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যান্সেট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে চণ্ডীগড়ের ডি ভি দত্ত দেহাভ্যন্তরের কিছু ক্যানসারের কারণ যে আর্সেনিক, এই ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। 1988- তে শেঠ সুখলাল কারনানি হাসপাতালের চিকিত্সক, ডি এন গুহমজুমদার দেখান 67 জন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর মধ্যে 62 জনের ত্বকে আর্সেনিক রোগলক্ষণ (dermatosis) ও লিভারের গোলমাল (hepatomegaly) পানীয় জলে 200 থেকে 2000 ug/L আর্সেনিক উপস্থিতির দরুন।
1988 সাল থেকে শুরু হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়রনমেণ্টাল স্টাডিজের দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও তাঁর সহকর্মীদের আর্সেনিক বিষণের জানপদিক সমীক্ষা। সেই কাজ দুই বাংলায় এখনও তাঁরা অক্লান্তভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ দুই বাংলার আর্সেনিক সমস্যা শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বের নজরে এসেছে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এরকম একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও প্রশাসনের টালবাহানার ইতিহাস বিগত 15-20 বছরের সংবাদপত্র ও বিজ্ঞান পত্রপত্রিকায় স্থায়ী হয়ে আছে। 1984-র শেষ সরকার নিযুক্ত কমিটি একটি রির্পোট দাখিল করেন। সরকারি টালবাহান চলতেই থাকে। তবে এই সময়ে দেশে ও বিদেশে পরিবেশীয় আর্সেনিকের ওপর গবেষণা বাড়তে থাকে। সংবাদপত্র ও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমও গুরুত্ব দিয়ে নানান অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতেই থাকে। বিজ্ঞানীরা ক্রমাগতই সতর্ক করতে থাকেন যে, জলের আর্সেনিক বিষণ বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে বহু লক্ষ মানুষ ক্যনসারে আক্রান্ত এবং সহস্র সহস্র হেকটর জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাবে, খাদ্যশৃঙ্খলে আর্সেনিক বাড়বে।
অবশেষে 1988 সালে সরকার নিযুক্ত আর একটি কমিটি 1991 সালে তাদের রির্পোট পেশ করেন। 1992-এর এপ্রিল গভর্নমেণ্ট আরও একটি কমিটি নিযুক্ত করেন, যার রির্পোট বের হয় 1994 সালের অকটোবরে। এই কমিটিতেও মতভেদ ছিল, এমনকি একজন সদস্য পদত্যাগও করেন। 1993 সালে গভর্নমেণ্ট আর্সেনিক অনুসন্ধানের জন্য বিশেষ কর্মী বাহিনী নিযুক্ত করেন। 1995 সালে আর একবার 1998 সালে আরও একবার, আবারও 2001 -এ কমিটিতে মতভেদ দেখা দেয় যার পরিণতিতে আবারও একজনের পদত্যাগ। যাইহোক এই ক্লান্তিকর ইতিহাস আর দীর্ঘায়িত না করে এই বলে শেষ করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবাংলায় (বাংলাদেশের অবস্থাও বিশেষ ভিন্নতর নয়) সরকারি শৈথিল্য ও উদাসীনতার সঙ্গে যুক্ত যথেষ্ট মাত্রায় প্রশাসনিক গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা।
পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই গঙ্গা-ভাগিরথী, গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ও মেঘনার (GBM) পলিগঠিত বদ্বীপ অঞ্চল। পৃথিবীর এই বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চলটিই আজ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা আর্সেনিক পীড়িত। লক্ষণীয়, পশ্চিমবঙ্গে ভাগিরথীর পশ্চিমদিকে আর্সেনিক অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলই অধিক আর্সেনিক অধ্যুষিত। একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বরিন্দ ও মধুপুর অঞ্চল অপেক্ষাকৃত কম আর্সেনিক মুক্ত। ঢাকা শহর আর্সেনিক মুক্ত, কিন্তু কলকাতা নয়। দুই বাংলার পলিমাটি ও বদ্বীপীয় অঞ্চলেই আর্সেনিকের প্রকোপ সমধিক। এই সব অঞ্চলে মাটির নীচে বা তার কাছাকাছি আর্সেনিকের বিশাল এমন কোনও আকর ভাণ্ডার নেই, যা ভূগর্ভজলে আর্সেনিকের এত বড় উত্স হতে পারে।
হাজার পাঁচেক বছর আগেও যখন উত্তর-পশ্চিম ভারতে উন্নত সিন্ধু সভ্যতা সজীব ছিল, তখনও বঙ্গোপসাগর বাংলায় বহুদূর বিস্তৃত ছিল। হয়তো রাঢ়, বরেন্দ্রভূমি, প্রাগজ্যোতিষপুর (বর্তমানের আসাম), রাজমহল পাহাড় ও শ্রীহট্টের পাহাড়ি অঞ্চলকে ছুঁয়ে যেত বঙ্গোপসাগরের নোনা জল। হিমালয় পর্বতকে ক্ষয় করে উত্তর ভারতের সমভূমি ধুয়ে সমুদ্র থেকে আসা পলি নিয়ে ভরাট করে যে বিস্তীর্ণ ভূভাগ গড়ে উঠল, তাই কালক্রমে হল বঙ্গভূমি। তিন-চার হাজার বছর আগেও নদীপলিগঠিত এই অঞ্চল জলাভূমি, শ্বাপদসংকুল ও জঙ্গলাকীর্ণই ছিল। ক্রমে রাঢ় (বর্তমানের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, বর্দ্ধমান, মেদিনীপুর), বরেন্দ্রভূমি (রাজশাহি, পাবনা, দিনাজপুর) ও আসামের মানুষ এইসব অঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তুলল। কালক্রমে গড়ে উঠল গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট প্রভৃতি রাজ্য। এইসব অঞ্চলের উর্বর জমি, নদী, পুকুর, কুয়ো প্রভৃতির বিপুল সুপেয় পানীয়জল, ক্ষেতে সোনার ফসল আর প্রকৃতির অন্যান্য উদার দান উপনিবেশী মানুষদের সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য এনে দিয়েছিল। অতীতে, অন্তত মুঘল আমলে, পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা ছিল শুধু ভারত নয়, সারা বিপুলভাবে বেড়ে যায় নতুন কৃষিপ্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে প্রধানত 1960-এর পর থেকে। পশ্চিমবঙ্গে 19টি জেলার মধ্যে 9 টি জেলাই আজ আর্সেনিক পীড়িত। আর্সেনিক আক্রান্ত জনসংখ্যা 4.27 কোটি। চাপা কলের সংখ্যা 30 থেকে 40 লক্ষ। সর্বাপেক্ষা আর্সেনিক-পীড়িত জেলাগুলি হল- মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ 24পরগণা। এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের আর্সেনিক পীড়িত অঞ্চলের সঙ্গে সংলগ্ন। ভাগিরথীর পশ্চিমপাড়ের আর তিনটি জেলা হাওড়া, হুগলি ও বর্ধমানের কিয়দংশ কম আর্সেনিক পীড়িত। এই প্রাকৃতিক ব্যাপারের সর্বজনগ্রাহ্য ভূতত্ত্বীয় ব্যাখ্যা আজও স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশের মোট আয়তন 144,000 বর্গ কিমি। 64 টি জেলার মধ্যে 50 টি জেলাই আর্সেনিক পীড়িত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা 97 জন মানুষ নলকূপের ভূগর্ভ জল ব্যবহার করে থাকেন। নলকূপের সংখ্যা আশি লক্ষ থেকে এক কোটি। বিষাক্ত আর্সেনিক জল খায় অন্তত সাড়ে তিন কোটি মানুষ। ঝুঁকি পূর্ণ অবস্থায় আছে প্রায় আট কোটি লোক।
ভূপ্রকৃতি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায় :
উত্তরাঞ্চলের উচ্চভূমি - হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল ও তার সানুদেশের দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়াং ইত্যাদি অঞ্চলের জলে আর্সেনিকের আধিক্য পাওয়া যায় নাই।
পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল - বিহারের ছোটনাগপুর মালভূমির কিয়দংশ এই রাজ্যের পশ্চিমদিকের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলার পশ্চিমভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলের মাটি কাঁকরযুক্ত, অনুর্বর। বৃষ্টিপাতেও কম, জনবসতিও কম। আর্সেনিকের কোনও খবর না থাকলেও জলে অন্য একটি গুরুতর দূষক ফ্লোরিন আছে। স্থানে স্থানে ফ্লোরিনের ভয়ানক আধিক্য।
গঙ্গা-ভাগিরথী রাজমহল পাহাড়কে বেষ্টন করে দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে। আর মূলস্রোত গঙ্গা-পদ্মা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পড়েছে।
সমভূমি অঞ্চল - উপরোক্ত দুই পার্বত্য ও উচ্চ অঞ্চল বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের শতকরা প্রায় আশিভাগ অঞ্চলই সমভূমি। তার মধ্যেও সামান্য পার্থক্য লক্ষণীয় এবং সেই পার্থক্যই আর্সেনিকের সম্ভাব্য পার্থক্যের উত্স।
ক) ভাগীরথীর উত্তর ও পশ্চিমের প্রাচীন পলিগঠিত অঞ্চলের ভূগর্ভজলে আর্সেনিক কম।
খ) ব-দ্বীপ অঞ্চল - ভাগিরথীর পূর্বদিকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপের অন্তর্গত এই অঞ্চলটি একটি বিস্তীর্ণ এবং উর্বর সমভূমি। প্রতিবছর নতুন পলি জমে এই অংশের আয়তন দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত বাড়ছে। এখানকার পলিস্তর খুব গভীর। কলকাতার 500 ফুট নীচেও কোনও শিলাস্তর পাওয়া যায় নি। পলিগঠিত দুই বাংলার ভূস্তর ভূতাত্ত্বিক বিচারে অসংগঠিত। এইসব অঞ্চলের অগভীর অ্যাকুইফারসমূহ থেকে আহরিত ভূগর্ভজলে আর্সেনিক খুব বেশি।
গ) দক্ষিণের নিম্নঞ্চল, জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যঞ্চল
নিকট অতীতে নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে সাগর ভরাট হয়ে এই অঞ্চলের সৃষ্টি। এখানে জলাভূমি ও কিছুটা অংশ সুন্দরবনাঞ্চল। এটিও আর্সেনিক সম্ভাবনা অঞ্চল।
মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.