Source
‘বর্তিকা’ শারদোত্সব সংখ্যা 2011
জলের এ-ধরণের রকমফেরের সুযোগ নিয়ে, মানুষের জলসম্পর্কিত আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা জলকে পণ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং এক অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া তারা ব্যবহার করে মানুষেকে হাতের পুতুলে পর্যবসিত করে চলেছে।
১) অরুণকান্তি বিশ্বাস প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা২) শ্রী সুজিত কুমার ভট্টাচার্য প্রাক্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার, গঙ্গা অ্যকশন প্ল্যান (কে. এম. ডি. এ)
কলকাতা পুরসংস্থা পরিশোধিত ভূ-পৃষ্ঠের জল নিয়মিত সকালে, দুপুরে, বিকেলে নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করার জন্য অনেকগুলো জলাধার নির্মাণ করেছেন কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন আয়তনের (যাতে 2 থেকে 5 মিলিয়ন গ্যালন জল রাখা যায়)। এমন 9টি জলাধার পুরসংস্থার বিভিন্ন প্রান্তে যেমন সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক, অকল্যাণ্ড স্কোয়ার, পার্কসার্কাস, বেহালা চৌরাস্তা, বাশদ্রোণী, কসবা, রাণীকুঠি এবং গরফা শিশুউদ্যানে তৈরি করা হয়েছে এই সব জলাধারগুলিতে বিভিন্ন জল পরিশোধনের প্রকল্পের জল এলাকাভিত্তিক সঞ্চিত করে, সংলগ্ন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে পুনায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্লোরিনেশন করে দৈনন্দিন জল সরবরাহের ব্যবস্থাপনা করা হয়।
এবার আসি, যে জল পুরসংস্থা সরবরাহ করে থাকেন তা কতটা পেয় জল, তার গুণাগুণ, কিছু তথ্য জানা বা আভাস নেওয়া- যা সময়ের সাথে, ঋতুর সাথে পরিবর্তন হয়ে থাকে। 2000 সালে কলকাতায় অবস্থিত এক কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে (ন্যাশনাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে নীরি) কলকাতায় বিভিন্ন অঞ্চলের জলের নমুনা সংগ্রহ করে থাকে। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে রাসায়নিক পদার্থঘটিত গুণাগুণ যেমন দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ (T D S), আয়রন (Fe), ক্লোরাইড (CI), ক্ষার (Hamess) ইত্যাদির মান নির্ধারিত মাত্রা (ISI 10500, 1991)-র মধ্যে আছে, কিন্তু জলবাহিত কিছু জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যায়। গুণাগুণ অনুযায়ী পানীয় জলকে স্বচ্ছ, গন্ধহীন-সহ শুধুমাত্র রাসায়নিক পদার্থ লবণের মাত্রার মধ্যে যেমন থাকা উচিত তেমনি একান্ত জুরুরি ফিকাল কলিফর্ম (Fecal Coliform bacteria) না থাকা। কিন্তু বেশ কম মাত্রায় হলেও কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া (1-5 / 100 মিলিমিটার মাত্রায়) কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়, বিশেষ করে বর্ষাকালে যথাযথ ক্লোরিনেশন করা সত্ত্বেও। সুপারিশ অনুযায়ী জল সরবরাহের আগে জলাধারের জলকে পুনরায় নির্ধারিত মাত্রায় ক্লোরিনেশন করার ব্যবস্থাপনা আছে। তবুও বলা যায় জল সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত নয়, বারে বারে পরীক্ষার প্রয়োজন আছে নলের মুখের কাছাকাছি। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, জলসরবরাহের দীর্ঘপথ পরিক্রমার সময় বেশ কিছু জায়গায় পাইপের জয়েণ্টের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে নোংরা জলের অনুপ্রবেশ, কখনো হয়তো নোংরা জঞ্জাল ও নর্দমার পাশ দিয়ে জলসরবরাহের পাইপের গতিপথ- সব মিলিয়ে পেয় জল অপেয় হয়ে পড়ে। ব্যবহারকারীরা জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যেটা প্রায়শই খবর হয়। দেখতে হবে নিয়মিতভাবে কলের নলের জলে রেশিজুয়াল ক্লোরিন (Residual Chlorine) নির্ধারিত মাত্রায় আছে কি-না।
জলের এ-ধরণের রকমফেরের সুযোগ নিয়ে, মানুষের জলসম্পর্কিত আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা জলকে পণ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং এক অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া তারা ব্যবহার করে মানুষকে হাতের পুতুলে পর্যবসিত করে চলেছে।
কেন মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে জলবাহিত রোগের আক্রমণে তার একটু ধারণা করা যাক। রোগগুলি সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হচ্ছে। জলবাহিত রোগের মধ্যে প্রধানত ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ - যেমন ভাইরাল হেপাটাইটিস-এ (Viral hepatitis-A), হেপাটাইটিস- ই, পোলিওমাইলোইটিস (Poliomyelitis), ভাইরাল ডায়ারিয়া ও রোটা ভাইরাসজনিত উপসর্গ উল্লেখযোগ্য। এর ফলে খিদে কমে যায়, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হয়, বমিভাব হয়, পোলিমাইলোইটিস রোগে স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত শিশুরা অনেকসময় পঙ্গু হয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমাদের দেশে প্রতি দু মিনিটে একজন শিশু পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়। ব্যাকটেরিয়াঘটিত অসুস্থতায় যেমন টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েড (Typhoid & Paratyphoid Fever), ব্যাসিলারি ডিসেণ্ট্রি, ই, কোলি ডায়ারিয়া (Esch. Coli Diayrhoea), কলেরা (Cholera), প্রোটোজোয়াল (Protozoal), অ্যামিবিয়াসিস (Amoebisis), জিয়ার্ডিয়াসিস (Giardiasis)- এ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া জলজ পতঙ্গবাহিত অসুস্থতা যেমন ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়া এবং জলজ প্রাণীবাহিত অর্থাত গিনিওয়ার্ম, সিস্টোসোমিয়াসিস রোগেও অনেকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমাদের এ-ও জানা দরকার যে অপেয় জল দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার বেশি থাকলে নানান অসুস্থতার কবলে পড়তে হয়। যেমন জলে নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি থাকলে মিথিহিমোগ্লোবিনিমিয়া, অর্থাত রক্তের হিমোগ্লোবিন আক্রান্ত হয় বা আর্সেনিক থাকলে চর্মরোগ ও অ্যানিমিয়া, ক্রোমিয়াম থাকলে ক্যান্সার ও চর্মরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য হবার সম্ভাবনা থাকে।