কলকাতা পুরসভা ও জলপরিশোধন

Submitted by Hindi on Thu, 01/12/2017 - 14:34
Source
‘বর্তিকা’,শারদোত্স সংখ্যা, 2011

কলকাতা অঞ্চলে গড় প্রতি - প্রতি জনে প্রতি দিনে 500 থেকে 600 গ্রাম কঠিন বর্জ্য পদার্থ উত্পাদিত হয়, তার মানে পরিমাণগত ভাবে প্রতি দিন 3000 থেকে 3500 টন। আবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে হাসপাতাল, অগুনতি নার্সিংহোম থেকে উত্পাদিত বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ( Biomedical ), বাজার বা হাট ( market place ) থেকে উত্পাদিত জঞ্জাল আবর্জনা। যদিও পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে কলকাতা থেকে উত্পাদিত যে সমস্ত বর্জ্য পদার্থ তার মধ্যে গড়ে 50 শতাংশ জৈব, 20 থেকে 30 শতাংশ মাটি ও অজৈব আর বাদবাকি কাগজ, প্লাস্টিক, চামড়া, কাঁচভাঙা ইত্যাদি ইত্যাদি।

কলকাতা পুরসংস্থা যে পরিশোধিত জল সরবরাহ করে থাকে তাতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি কিছু কিছু জায়গায় কিছু কিছু সময়ে থাকলেও রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার অনেক কম। কারণ পুরসংস্থা শোধন প্রণালীতে নির্ধারিত মাত্রায় ফটকিরি (Alum) ব্যবহার করে জলের দ্রবীভূত ও ভাসমান পদার্থকে অধঃপতিত করে পাতন প্রক্রিয়া (Filtration) মাধ্যমে পরিশ্রুত করেও গ্যাসীয় ক্লোরিন (Chlorine gas) ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করে। এইসব ব্যবস্থাপনা করতে পুরসংস্থার খরচ হয় 3.50 টাকা থেকে 4 টাকা প্রতি এক হাজার লিটার জল উত্পাদনের জন্য। এবং তা সরবরাহ করার জন্য প্রায় একই পরিমাণ খরচা হয়ে থাকে অর্থাত সব মিলিয়ে প্রতি হাজার লিটার জলের জন্য খরচা হয় 7 থেকে 8 টাকা।

জল যেভাবে অপচয় হয় এবং জলকে যেভাবে ব্যবহার করা হয় সেই জলকে বাঁচাবার জন্য, নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করার প্রয়োজন আছে। আরও প্রয়োজন আছে প্রতিটি নলের আগে মিটার লাগানো ও সুষ্ঠভাবে জল ব্যবহার করার জন্য জল করের প্রয়োজন আছে। নতুবা জল অপচয়, জলকে সঠিকভাবে পেয় জলে পরিণত করার ব্যবস্থাপনা এক দিন না এক দিন ভেঙে পড়বে আর আমরা সকলে হয়ে পড়ব জলের ব্যবসায়ীদের কাছে পুতুল মাত্র।

এই ব্যবস্থাতেও দেখা যাচ্ছে অনেকের আপত্তি আছে, অথচ কর্পোরেট সংস্থার ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপণের মোহে পড়ে আমরা প্রতি লিটার জল 12 থেকে 15 টাকায় কিনছি, পান করছি, না জেনে যে এই জল প্রকৃতপক্ষে পেয় জল নাকি পেয় জল নয়। কারণ জলের কারবারি এইসব ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো অনেক সময় সঠিকভাবে নিজস্ব জলের উত্সকে ভালভাবে পরিশুদ্ধ না করে, কলকাতা পুরসংস্থার জলই ব্যবহার করে বোতলের মাধ্যমে বিক্রি করে মানুষজনকে বোকা বানাচ্ছে দিনের পর দিন। সঠিকভাবে কোনও রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় না, কোনো রকমের সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই কিন্তু ব্যবসা রমরমিয়ে করে যাচ্ছে। এমন একটা দিন আমাদের সামনে আসছে, এই সব কর্পোরেট সংস্থা ( দেশি ও বিদেশি ) দেশি দালালদের সহায়তায় জলের বাজার বাডা়তে বাড়াতে একদিন দেশের নদী, জলাশয়, ভূগর্ভস্থ জলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসবে আর আমরা হয়ে পড়ব তাদের হাতের পুতুল, তারাই চালনা করবে সমগ্র পরিস্থিতি ।

এত গেল শুধুমাত্র কলকাতার জলচিত্র। জল ছাড়াও কলকাতার পরিবেশ সম্পর্কে আরও কিছু জানা দরকার। যেমন যে জল আমরা ব্যবহার করলাম তা থেকে যে নোংরা জল উত্পাদিত হয় সেই নোংরা জলের কিন্তু কোনোরকম সঠিক ব্যবস্থাপনা কলকাতা পুরসংস্থা এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। ফলত নোংরা জলের একটা বেশ বিশাল একটা অংশ বিভিন্ন নর্মদা, নালার মধ্য দিয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় গঙ্গার জলে গিয়ে মিশছে আর মিশে গিয়ে গঙ্গার জলকে করে তুলছে দূষিত ।

কোথাও কোথাও আংশিক পিউরেজ পদ্ধতি ও আংশিক বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে কলকাতার নোংরা জল পরিশোধিত হয়ে থাকে বটে কিন্তু বাকি অংশটা বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে storm Weather Flow (SWF) Dry Weather Flow (DWF) খালের মধ্য দিয়ে নোংরা জলকে উগরে দেয়। এই খালটার নাম পচাখাল হিসেবে পরিচিত। বহমান এই নোংরা জলকে অবৈজ্ঞানিক ভাবে ও অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চাষবাসের কাজে ও মাছ চাষ উত্পাদনে লাগানো হয়ে থাকে। কলকাতা পুরসংস্থার তত্ত্বাবধানে মাত্র তিনটি নোংরা জল পরিশোধন কেন্দ্র (STP) বর্তমানে অনিয়মিত ভাবে চলেছে। যেমন গার্ডেনরিচে (47.5 MLD) একটি ও দ্বিতীয়টি সাউথ সুর্বাবণে (30 MLD) আর তৃতীয়টি হল কাশীপুরে (45 MLD) ।

নোংরা জল পরিশোধন কেন্দ্রগুলি (STP) সঠিকভাবে চালানোর জন্য যে-ধরণের ব্যবস্থাপনা (Infrastructure) ও অভিজ্ঞ মানুষের দরকার পড়ে তাদের অনুপস্থিতির কারণে কেন্দ্রগুলি ঠিকমতো চলানো সম্ভব হচ্ছে না, ফলত নোংরা জলের পরিশুদ্ধতা নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে থাকছে এবং আংশিক পরিশোধিত জলও গঙ্গার জলের সাথে মিশে গিয়ে গঙ্গার জলকে একেবারে পানের অযোগ্য করে তুলছে।

এর সাথে সোনায় সোহাগার মত যুক্ত হয়েছে কঠিন বর্জ্য পদার্থ। কলকাতা অঞ্চলে গড় প্রতি - প্রতি জনে প্রতি দিনে 500 থেকে 600 গ্রাম কঠিন বর্জ্য পদার্থ উত্পাদিত হয়, তার মানে পরিমাণগত ভাবে প্রতি দিন 3000 থেকে 3500 টন। আবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে হাসপাতাল, অগুনতি নার্সিংহোম থেকে উত্পাদিত বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ( Biomedical ), বাজার বা হাট ( market place ) থেকে উত্পাদিত জঞ্জাল আবর্জনা। যদিও পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে কলকাতা থেকে উত্পাদিত যে সমস্ত বর্জ্য পদার্থ তার মধ্যে গড়ে 50 শতাংশ জৈব, 20 থেকে 30 শতাংশ মাটি ও অজৈব আর বাদবাকি কাগজ, প্লাস্টিক, চামড়া, কাঁচভাঙা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সমস্ত বাদ দিয়েও রয়েছে কলকাতা পুরসংস্থা পরিচালিত 24 টি বোরো হেলথ ক্লিনিক এবং 5 টি ম্যাটারনিটি, 1 টি টিবি হাসপাতাল ও 41 টি ম্যালেরিয়া ক্লিনিক আর 50 টি হেলথকেয়ার ইউনিট ( সহায়তায় পরিচালিত ) এ ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোম থেকে প্রতিদিন প্রতি বেডে মোটামুটি ভাবে 1 থেকে 1.4 কেজি (1-1.5kg) বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট উত্পাদিত হয়ে চলেছে।

কাগজকুড়ানিরা শহরের বর্জ্য পদার্থের 15 শতাংশ সংগ্রহ করে বিক্রি করে দেয় পুনঃ ব্যবহারের জন্য। এইসব অসংগঠিত মানুষজনেরা এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে থাকেন বা বলা যায় করতে বাধ্য হন এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক অব্যবস্থার মধ্যে। তবুও এ কথাটা বলাই যায় যে এনারাই পুরসংস্থাকে জঞ্জালের ভার থেকে খানিকটা হলেও মুক্ত করে থাকেন। বাকি 65 শতাংশ সরকারি ও বেসরকারি গাড়ির মাধ্যমে ধাপাতে নিয়ে গিয়ে কোনোরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে, কার্যত কোনরকম তোয়াক্কা না করে খোলা আবর্জনার স্তূপে ফেলা হয়। বাকি 10 শতাংশ জঞ্জাল যত্রতত্র রাস্তায় পড়ে থাকে, যদিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে জঞ্জাল সংগ্রহ করার পদ্ধতি বর্তমান – তা-ও ঠিকমতো কাজ হয় না।

এখানে একটা কথা বলে রাখতে হয় যে, কলকাতা পুরসংস্থা একটি বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে ধাপাতে একটি সার তৈরির কারখানা করেছে, যেখানে প্রতিদিন 700 টন জৈব সার তৈরির ব্যবস্থাপনা আছে, কিন্তু দুঃখের কথা তা-ও ঠিকমতো চলে না, প্রচুর পরিমানে অজৈব পদার্থ মিশ্রিত থাকে, সারের বাজারও সেইমতো তৈরি হয়ে ওঠেনি, সেইমতো প্রচেষ্টাও নেই।

ধাপাতে যে আবর্জনার স্তুপ আছে, বা যেখানে নিয়মিত আবর্জনা ফেলা হয় তা থেকে যেমন বায়ুদূষণ ঘটে, তেমনই চুঁইয়ে চুঁইয়ে আবর্জনা স্তুপের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আশপাশের অঞ্চলের জলাশয়গুলি ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে, জমা জঞ্জালের স্তুপ থেকে মিথেন নির্গত হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে ও বিশ্ব-উষ্ণায়নে সহযোগিতা করে চলেছে। পুরসংস্থার সে মতো কোনো পরিকল্পনা নেই যে একে কী ভাবে একে রোধ করা যায় তার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য।

যখন বায়ু দূষণের কথাই এল তখন কলকাতার বায়ু কীভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে, তার সম্পর্কে একটু কথা বলা যাক। যা অনুভূত হয় শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে। প্রথমত এবং প্রধানত অনিয়ন্ত্রিতভাবে যানবাহনের ব্যবহার, বিশেষ করে অটো, মিনিবাস, বাস, লরি হচ্ছে কলকাতার বায়ুদূষণের প্রধানতম কারণ। বিশেষ করে ভাসমান ধূলিকণা (Suspended Particulate Matter) শ্বাসযোগ্য ধূলিকণা, (Respiratory Particulate Matter), অক্সাইড অফ নাইট্রোজেন, অক্সাইড অফ সালফার (Oxides of Nitrogen, Oxides of Sulpher) প্রায়শই নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে থাকে। মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত অসুস্থতা ( Respiratory diseases ) ছাড়াও মানুষ চোখজ্বালা, মাথাধরা ইত্যাদি নানান উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

জলের ব্যহার, বায়ুদূষণ, বর্জ্যপদার্থের দ্বারা দূষণ – এ সবগুলির মাত্রাই ক্রমবর্ধমান। এর বিধান কল্পে বা প্রতিকারের জন্য সরকারকে অনেক আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে, পরিবেশ দপ্তরের মাধ্যমে সমস্যাকে সমাধান করতে হবে। অনেক বেশি বেশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার করা ছাড়াও আরও যেটি করতে হবে তা হল মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে, মানুষের সহযোগিতার প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। তবেই কলকাতা এক সুন্দর শহরে পরিণত হতে পারবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মেরা এক দূষণহীন সুন্দর শহরের বাসিন্দা হবে।

প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা ও শ্রী সুজিত কুমার ভট্টাচার্য, প্রাক্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার, গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান (কে. এম. ডি. এ.)