মধুতটি ও অন্যান্য

Submitted by Hindi on Mon, 01/23/2017 - 10:13

. মধুতটি একটা ছোট নদী। এত ছোট যে মনে হয় নামটা লিখতে যতোটা জায়গা লাগে তাতেই ওর বয়ে যাওয়া কুলিয়ে যায়। এরকমই আরেকটা নদী ছিল অসমে, নাম লেখার জায়গাটার সমান চওড়া, তার নাম দীঘলতরঙ্গ। ডিব্রুগড়ের খানিক আগে ডিব্রু নদীতে এসে মিশত সে।

আমি প্রায়ই ভাবি, কে রাখত এসব নদীর নাম। কি করে অন্যেরা জানতে পারত সেই নামগুলো, কী করেই বা এটা ঘটত যে সকলেই নদীটিকে ডাকত সেই নামেই? সেই মীডিয়াহীন যুগে? আর এমন সুন্দর সব নাম! বিশেষত বাংলার নদীদের নাম তো যেন তুলনাহীন। মনে হয় এই মধুর ভাষাইয় যতো সুন্দর শব্দ আছে, খুঁজলে দেখা যাবে হয়ত যে তার সবগুলো দিয়েই মানুষরা কোন না কোন নদীর নাম রেখেছেন। বড়োনদীদের কথা ছেড়ে দিলাম, গঙ্গা গোদাবরী কৃষ্ণা নর্মদা যমুনা কাবেরী না হয় থাক, কিন্তু ঘরের পাশে যে ছোট ছোট নদীরা, নিজের জায়গার ছোটখাট ঘটনা কি কোন নদীর স্বভাব মিলিয়ে নদীদের নাম। জোয়ার ভাঁটার বিশাল ঢেউয়ে টলমল করে যে তার নামই মাতলা। আবার তারই পাশের নদীটি কেন মঙ্গলে যুক্ত রায়মঙ্গল নাম পায়, কে বা জানে। রায় নাহয় প্রধান কিম্বা মহিমা সূচক, কিন্তু তার এমন মহিমা কিসে? সুন্দরবনের প্রধান এই দুই ধারা। আবার সেই সুন্দরবনেই যে চঞ্চল নদীরা কার হেঁসেল ভাসিয়ে হাঁড়ি ভেঙেছে, ভেঙেছে কার সাধের বাদ্যযন্ত্র, তাদের দুর্নাম রটে গেছে হেড়োভাঙা, মৃদঙ্গভাঙা বলে। বাড়ির দুষ্টু ছেলে কি মেয়ে বড়ো হয়ে গেলেও যেমন তার শৈশবের কুকীর্তিগুলো স্মরণ করেই তাকে আদর জানানো হয় তেমনই নাম হুঁকাহারানিয়া-র। যার হুঁকো ছিল সে সুদ্ধ কোথায় নিরুদ্দেশ, লোকে তবু ভারি আদরে মনে রেখেছে সেই হারাণো টুকুকেই।বে ছিল মুন্ডাদের জলের সঞ্চয়, তাদের অঞ্চলের নদীর নাম ছিল ‘দা মুন্ডা’-মুন্ডাদের জল। ভদ্রমানুষরা নারায়ণের নামে তার নাম দিলেন দামোদর। সম্মান কি কম! মহিমময়ী দুর্গা যে দেশে ঘরের কন্যারূপিনী হন, আশ্চর্য কি যে সেখানে ছোট্ট এক দুমুখ খোলা, দুমুখে জোয়ারভাঁটা খেলানো নদীর নাম হবে দুর্গাদোয়ানি। যাকে জয় করা যাবে না বলে আশপাশের মানুষদের আশা, অভিজ্ঞতাও বটে, সে নদীর নাম আর কি হতে পারে অজয় ছাড়া? হলই বা আজ তার বুকে হাজার বালিখাদের ক্ষত, দুপাশের মাঠে পাথরখাদানের টেনে ফেলে দেওয়া জলে এককালের দুরন্ত স্রোতধারার অতীতের স্বপ্ন বুকে আজ জলহীন শ্বাস টেনে চলা।

যে চিরকালই ছিল হয় দুর্বল নাহয় তো খেয়ালি, মাঝে মাঝেই অদর্শন হলেও পাশের লোকেরা জানেন সে আবার ফিরে আসবে, একেবারে হারাবে না। সে নদীর পরম ভরসাময় নাম তাই পুনর্ভবা। নদীর নাম ইচ্ছামতী, নদীর নাম শতধারা, আঠেরোবাঁকি কুমারী কাজলা। বীরভূমের গ্রামের মধ্যে ছোট নদী, নাম চাঁদের জল।পাশের গ্রামটির নাম চাঁদনি। মনে হয় এদেশ ছেড়ে আর কোথাও গিয়ে থাকব কী করে ! সাঁওতালি ভাষায় বড়ো নদীকে বলে ‘মর’। জঙ্গলের দেশে, বীরভূমে, বাস করতে আসা হাসিমুখ মানুষেরা সেই নামেই ডাকলেন কাছের বড় নদীটিকে। পরে ব্যবসা করতে আসা অন্য ভাষাভাষীরা মর কে ঈষৎ হেলিয়ে উচ্চারণ করলেন মোর। তাদের ভাষায় ময়ূরের এই নাম। নদীর সঙ্গে ময়ূরের মিল খুঁজে হয়রাণ হওয়া বেকার। বরং বাঙালিরা আরেকটু এগিয়ে গেলেন।অন্য এক নদীর প্রিয় স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে, এ নদীর নাম হয়ে গেল ময়ূরাক্ষী। সাঁওতালদের দেওয়া নাম বুকে করে অবশ্য এখনও বয়ে যায় আহ্লাদী ডুলুং। সে ভাষায় এ শব্দ বর্ণনা করে প্রাণোচ্ছল মেয়ের, হড়কুড়ি-র হেলেদুলে চলাকে। সাঁওতালি ভাষায় না হলেও ওরকমই প্রাচীন অস্ট্রোলয়েড ভাষায় চলন্ত জলধারাকে বলে ‘সাই’। পুরুলিয়ার নদীর নাম কাঁসাই, ন্যাংসাই। টটকো- মানে যে অনেকদূর পথ চলছে। টটকো নদী কতোদূর থেকে আসে, তাকে বহুদূর বলা যায় কি না জানি না, কিন্তু পাথর চাট্টানের দেশ পুরুলিয়ায় এ নদীতে বারোমাস ভরা স্রোত থাকত, একথা ঠিক। কাঁসাইয়ের পাড়া দিয়ে চলে সোনার নদী- সুবর্ণরেখা। কেন যে তার এই নাম, কে জানে! লোকে বলে ওর বালিতে নাকি কখনো কখনো সোনার দানা পাওয়া যায়। কিন্তু তাহলে তো তার নাম হতে পারত সোনাকণা কি সোনাবতী। রেখাটিতে সোনার কথা এলো কেন! ওদিকে আবার কী যে মণির খোঁজ আছে তার কাছে, কে জানে, বীরভূমের যে ছোট নদীর নাম মণিকর্ণা। এখন তো বছরভর তার দেখাই নেই, বোরো ধানের ক্ষেতের নিচে চাপা পড়া সে নদীকে দেখা যায় আজকাল কেবল বর্ষায় তুমুল বানভাসি হলে। সোনার নদী সোনাবতী নয়, শিলায় ভরা নদী কিন্তু আমাদের শিলাবতী। পাথরে পা রেখে টপকে চলে তার জল। বাঁকুড়ার গ্রামে ভারি সুন্দর গল্প আছে এই শিলাবতী আর একই উৎস থেকে ওঠা জয়পন্ডা নদীকে নিয়ে। সেই গল্পটা আমাকে বলেছিল দুর্গাপুরের মণিশংকর। কিন্তু কার ঘোড়া ডুবিয়ে রামপুরহাটের ছোট নদীর নাম যে ঘোড়ামারা, সে গল্প কেউ বলতে পারে নি।

এইসব নামের মধ্যে নিহিত যে ভালোবাসা, যে কল্পনার সৌন্দর্য, সেই ঐশ্বর্যই নদীগুলিকে বহতা রেখেছিল। নদীদের তার পাশের মানুষরা জানতেন প্রকৃতির দান বলে। তাকে নিজের একার কাজে লাগিয়ে, একা কারো স্বার্থে নদী নষ্ট করার কথা কখনো ভাবত না। ভাবার চল ছিল না। প্রতিটি নদীই শ্রীমতী। তাদের ভালোবেসে, যত্ন করে রক্ষা করার নিয়মটি মেনে চললে, তাতে মানুষের স্থায়ী কল্যাণ।